গত বছর মশার উৎপত্তিস্থল খুঁজতে আধুনিক প্রযুক্তির ড্রোন ব্যবহার করেছিল ডিএনসিসি। এবার ডেঙ্গু মোকাবিলায় শহরজুড়ে যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এডিস মশার প্রজননস্থল এবং পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ পরিত্যক্ত পলিথিন, চিপসের প্যাকেট, আইসক্রিমের কাপ, ডাবের খোসা, অব্যবহৃত টায়ার, কমোড ও অন্যান্য পরিত্যক্ত দ্রব্যাদি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কিনে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি। যদিও এখনও অর্থছাড় না হওয়ায় গতি আসেনি উদ্যোগটিতে। কাউন্সিলররা নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে এসব পরিত্যক্ত দ্রব্য কেনায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন কম। ফলে যে লক্ষ্যে উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছিল সেটির সফলতা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
ডিএনসিসির পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, পরিত্যক্ত পলিথিন, চিপসের প্যাকেট, আইসক্রিমের কাপের মতো পরিত্যক্ত দ্রব্য হচ্ছে এডিস মশার প্রজননস্থল। রাজধানীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসব পরিত্যক্ত দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে ধ্বংস করা গেলে ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
প্রতিটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরের কার্যালয়ে গিয়ে যে কেউ এসব পরিত্যক্ত দ্রব্যাদি জমা দিয়ে নগদ অর্থ সংগ্রহ করতে পারবেন। প্রতিটি ওয়ার্ডের ক্রয় করা পরিত্যক্ত দ্রব্যাদি প্রতিদিন নিয়মিতভাবে সংগ্রহ করে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নিকটবর্তী এসটিএস (সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন) এ অপসারণ করবে। জনগণকে সম্পৃক্ত করে প্রতিটি ওয়ার্ডকে পরিচ্ছন্ন করার লক্ষ্যে এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সংস্থাটি। যদিও এর সফলতা নিয়ে সংশয় রয়েছে নগর পরিকল্পনাবিদদের।
যে দামে পরিত্যক্ত দ্রব্য কিনছে ডিএনসিসি
বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চিপসের প্যাকেট বা সমজাতীয় প্যাকেট প্রতি ১০০টির জন্য ১০০ টাকা করে মূল্য দেবে ডিএনসিসি। একইভাবে আইসক্রিমের কাপ, ডিসপোজেবল গ্লাস, কাপ ১০০টি ১০০ টাকা; অব্যবহৃত পলিথিন প্রতি কেজি ৫০ টাকা; প্রতি ডাবের খোসা ২ টাকা; মাটি, প্লাস্টিক, মেলামাইন, সিরামিক ইত্যাদির পাত্র প্রতিটির জন্য ৩ টাকা করে দেবে ডিএনসিসি।
এছাড়া পরিত্যক্ত টায়ার প্রতিটি ৫০টাকা; পরিত্যক্ত কমোড, বেসিন ইত্যাদি প্রতিটির জন্য ১০০ টাকা, পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের দ্রব্যাদি প্রতি কেজি ১০ টাকায় কিনে নিচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন।
ঢাকঢোল পিটিয়ে এসব কেনার উদ্যোগ নিলেও মাঠ পর্যায়ে এ কার্যক্রম গুছিয়ে আনতে পারেনি ডিএনসিসি। কাউন্সিলর অফিস থেকে এসব পরিত্যক্ত পণ্য কিনে নিতে তহবিল পৌঁছায়নি, ফলে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে এসব কেনার আগ্রহ কম কাউন্সিলর অফিসের।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের এক কাউন্সিলর বলেন, এসব কেনার জন্য সিটি কর্পোরেশনের প্রধান কার্যালয় থেকে এখনও অর্থছাড় দেওয়া হয়নি। যে কারণে কাউন্সিলরদের কেউ কেউ নিজ পকেটের টাকা দিয়ে এসব কিনছেন। অর্থছাড় না হওয়ায় অনেকই এগুলো কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
তবে ডিএনসিসি থেকে বলা হচ্ছে, ৫৪টি ওয়ার্ডেই একযোগে এসব পরিত্যক্ত পণ্য কিনে নেওয়া হচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি অর্থছাড় হয়ে আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে কাউন্সিলরদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।
যা বলছেন নগরবাসী
অভিজাত এলাকা থেকে নিয়ে বস্তি, রাজধানীর এমন কোনো স্থান পাওয়া যাবে না যেখানে মশার উপদ্রব নেই। বছরের নির্দিষ্ট মৌসুমে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার উপদ্রব থাকলেও বছরজুড়ে থাকে কিউলেক্সসহ সাধারণ মশার উপদ্রব। মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগ ‘লোক দেখানো’ বলে সমালোচনা করছেন ঢাকার নাগরিকরা।
রাজধানীর বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা শাহিনুর রহমান তূর্য বলেন, সিটি কর্পোরেশন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্যোগ নেয় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে। এসব খবর আমরা শুধু টিভি, পত্র-পত্রিকায় দেখি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। গত বছর আমার আশেপাশের এলাকা, আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে অনেকের ডেঙ্গু হয়েছিল। এবারও আমরা সবাই ভয়ে আছি। বাসায় ছোট বাচ্চারা আছে, যে কারণে ভয়টা আরও বেশি। বছরের অন্যান্য সময় মশার ওষুধ দেওয়ার লোকজন একেবারেই দেখি না বললে চলে। তারা শুধু বড় বড় বুলি ছড়ায়। এবার শুনেছি তারা চিপসের প্যাকেট, ডাবের খোসা, টায়ার জাতীয় পরিত্যক্ত পণ্য কিনে নিচ্ছে। এসব দিয়ে কি আর ডেঙ্গু মোকাবিলা করা যায়? এগুলো লোক দেখানো উদ্যোগ।
মিরপুর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা মাসুম আহমেদ রনি বলেন, দিনে-রাতে সবসময়ই বাসায় হয় কয়েল জ্বালিয়ে নয়তো মশারি টাঙিয়ে রাখতে হয়। সামনে আসছে ডেঙ্গুর মৌসুম। তখন যে কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে তা ভেবে আতঙ্কিত। কাজের কাজ কিছুই করে না সিটি কর্পোরেশন। তারা শুধু লোক দেখানো আর সবার কাছে সাময়িক বাহবা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। এবার তারা পরিত্যক্ত পণ্য কিনছে। এটা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে না। টোকাই ছাড়া সাধারণ মানুষ কি এসব কুড়িয়ে তাদের কাছে বিক্রি করতে যাবে?
মশক নিয়ন্ত্রণে উত্তর সিটির ব্যয় কত
মশা মারার পেছনে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের চলতি অর্থবছরের খরচ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ডিএনসিসির এবারের বাজেটে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের মধ্যে মশা নিধন কাজ পরিচালনার জন্য ৮৪ দশমিক ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে মশার ওষুধ কেনার পেছনে ব্যয় হচ্ছে ৪৫ কোটি টাকা। ৩০ কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে বেসরকারি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়োজিত মশককর্মীদের দিয়ে এর নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনায়।
এছাড়া মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ৭ দশমিক ৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে ডেঙ্গু মোকাবিলা, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ও প্রচারণায়। সবমিলিয়ে যা ১২১ দশমিক ৮৪ কোটি টাকায় ঠেকে।
মশা মারতে এত ব্যয় তবুও কেন নিয়ন্ত্রণে আসে না ডেঙ্গু, কেন কমে না মশার উপদ্রব? এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে মশা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি ঢেলে সাজাতে হবে, থাকতে হবে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা। সেজন্য মশার হটস্পট ম্যানেজমেন্টের পাশাপাশি প্রজননস্থল ধ্বংস করার কার্যক্রম নিতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করে লাভ নেই কোনো।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু মোকাবিলায় আমাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি। ডেঙ্গু রোগীর তালিকা অনুযায়ী তাদের ঠিকানা সংগ্রহ করে রোগীর বাড়িসহ আশেপাশের এলাকায় ব্যাপকভাবে সচেতনতা কার্যক্রম চালাতে আমি কাউন্সিলরদের নির্দেশনা দিয়েছি। সবাইকে নিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে করণীয় সম্পর্কে মতবিনিময় সভা করতে হবে। সচেতনতামূলক র্যালি করতে হবে। এজন্য প্রত্যেক কাউন্সিলরকে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ওষুধ প্রয়োগ, পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করার পাশাপাশি জনগণের সচেতনতা জরুরি।
পর্যাপ্ত জনবল-যন্ত্রপাতি আছে কি ডিএনসিসির
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে জানানো হয়, ডিএনসিসির আয়তন প্রায় ১৯৬.২২ বর্গ কিলোমিটার, এখানে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের বসবাস। এ বিশাল এলাকার জন্য জনবল-যন্ত্রপাতি অবশ্যই কম রয়েছে। তবুও মশক নিধন কাজে নিয়োজিত বর্তমান জনবলের মধ্যে মোট মশক নিধনকর্মী এক হাজার ১৩০ জন (ডিএনসিসি ২৫০ জন), সুপারভাইজার ৬০ জন, মশক নিধন কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির মধ্যে ফগার মেশিন ৭৬০টি, হস্তচালিত মেশিন ৮৫০টি, হুইল ব্যারো মেশিন ৬২টি, মিস্টব্লোয়ার মেশিন ৪০টি, ভেহিকেল মাউন্টেড ফগার মেশিন ১৫টি এবং নৌকা রয়েছে ৩০টি।