বরিশালের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে এক নতুন আশার আলো হয়ে উঠেছেন জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ পারভেজ। তার কাজ নিছক দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন নয়—বরং একটি মানবিক দায়িত্ব, যা সমাজের অবহেলিত মানুষদের জীবন বদলে দিচ্ছে। পেছনে পড়ে থাকা ভিক্ষুক, হিজড়া, অপরাধপ্রবণ যুবক কিংবা প্রতিবন্ধীদের জীবন ফিরিয়ে আনার যে লড়াই, তার নির্ভরযোগ্য সারথি হয়ে উঠেছেন এই কর্মকর্তা।

বেশ কয়েক বছর ধরে বরিশালে দায়িত্ব পালন করছেন সাজ্জাদ পারভেজ। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই তিনি বুঝেছিলেন, কাগজে-কলমে সেবার পরিকল্পনা যতই চমৎকার হোক, মাঠপর্যায়ে না গেলে মানুষের বাস্তব চিত্র বোঝা যায় না। তাই তিনি বেরিয়ে পড়েন অফিসের গণ্ডি পেরিয়ে—খুঁজে নেন শহরের প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অবহেলিত মানুষদের। যাদের সমাজ একসময় বর্জন করেছে, তাদের জন্যই গড়ে তুলেছেন পুনর্বাসনের পরিকাঠামো।
বরিশাল শহরের ট্রাফিক সিগন্যাল কিংবা বস্তিতে আগে যারা হাত পাততেন, আজ তাদের অনেকেই এখন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। সাজ্জাদ পারভেজের তত্ত্বাবধানে সমাজসেবা অধিদপ্তরের পুনর্বাসন প্রকল্পের আওতায় বহু ভিক্ষুককে ব্যবসার পুঁজি, প্রশিক্ষণ এবং মনোবিজ্ঞানভিত্তিক কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে তোলা হয়েছে। কারও এখন ছোট মুদি দোকান, কেউ কসমেটিকস বিক্রি করেন, কেউবা হস্তশিল্পের মাধ্যমে নিজের পথ গড়েছেন।

শুধু ভিক্ষুক নয়—হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। একসময় যারা জীবিকা নির্বাহ করতেন ভিক্ষা কিংবা চাঁদা তুলে, তারা এখন নিজের পরিচয়ে কাজ করছেন। সাজ্জাদ পারভেজ তাদের জন্য গড়ে তুলেছেন ভিন্নধর্মী উদ্যোগ, যেখানে তারা পায় প্রশিক্ষণ, পুঁজি, এবং ব্যবসার আইডিয়া। রসুলপুর বস্তির সাবেক হিজড়া ভিক্ষুকদের নিয়ে গঠিত একটি সমিতি এখন কসমেটিকস ব্যবসার মাধ্যমে আয় করছে মাসিক লক্ষাধিক টাকা।
অপরাধপ্রবণ তরুণদের ক্ষেত্রেও সাজ্জাদ পারভেজের প্রচেষ্টা এক কথায় ব্যতিক্রমী। প্রবেশন অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বরিশালের বিভিন্ন থানার তালিকাভুক্ত দুই শতাধিক তরুণকে পুনর্বাসনের আওতায় এনে সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনেন তিনি। অপরাধ থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তারা কেউ এখন গাড়ি চালায়, কেউ দোকান চালায়, আবার কেউ আবার নিজ উদ্যোগে সমাজসেবার কাজ করছে।

প্রতিবন্ধী নারীদের পুনর্বাসনেও তার অবদান অনন্য। পুনর্বাসন কেন্দ্রে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যেসব নারী একসময় সমাজে অবহেলার পাত্র ছিলেন, তারা এখন উপার্জনক্ষম। কেউ কেউ সংসার শুরু করেছেন, আবার কেউ স্বাবলম্বী হয়ে অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করছেন।
শুধু অফিসিয়াল প্রোগ্রাম নয়, ব্যাক্তিগত উদ্যোগেও পিছিয়ে নেই সাজ্জাদ পারভেজ। তার বন্ধুদের নিয়ে গড়া ‘ইভেন্ট-৮৪’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে তিনি সহায়তা করে চলেছেন দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের। এই সংগঠনের অর্থায়নে অনেক শিক্ষার্থী পেয়েছে বই, ভর্তি ফি, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার টিকিটও।

সাজ্জাদ পারভেজ প্রচারে বিশ্বাসী নন। তাই তার এসব উদ্যোগ নিয়ে বড় কোনও ব্যানার বা সোশ্যাল মিডিয়া প্রচারণা দেখা যায় না। তবে তার কর্মের কথা ছড়িয়ে পড়েছে মুখে মুখে, গলির চায়ের দোকান থেকে শুরু করে পুনর্বাসিত একেকজন মানুষের হাসিমুখে।

বরিশালের সমাজসেবায় এক নীরব বিপ্লব চালিয়ে যাচ্ছেন সাজ্জাদ পারভেজ। সরকারি কাঠামোর ভেতর থেকেও একজন কর্মকর্তা কতটা মানবিক হতে পারেন, তার প্রমাণ তিনি। তার এই যাত্রা শুধু বরিশালের জন্য নয়, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সমাজসেবা কর্মকাণ্ডের জন্যও এক অনুকরণীয় মডেল হয়ে উঠতে পারে। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন—প্রশাসনের পদ নয়, মন বড় হলে সমাজ বদলানো সম্ভব।
মন্তব্য করুন