Junaed siddiki
১১ জুন ২০২৪, ১২:১০ অপরাহ্ণ
অনলাইন সংস্করণ

ফিলিস্তিন সংকটঃ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

এশিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদ ফিলিস্তিন যা ভূমধ্যসাগর ও জর্ডান নদীর মাঝখানে অবস্থিত। এর অন্য দুই পাশ মিশর, জর্ডান, সিরিয়া ও লেবানন দ্বারা বেষ্টিত। ধর্মীয় চেতনায় এ জনপদ মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের নিকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পবিত্র ভূমি। ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি এশিয়া-আফ্রিকা ও ইউরোপের নিকট একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল

২। ফিলিস্তিনের নামকরন:
প্রাচীন মিশরীয় ও আসিরিয়ান শিলালিপিতে পেলেসেট, পলাশতু বা পিলিস্তি নামক অঞ্চলের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে কোন উৎস হতেই এর সুনির্দিষ্ট আঞ্চলিক সীমানা স্পষ্ট নয়। কালক্রমে রোম সম্রাট ইহুদীদের হেনস্তা করতে প্রচলিত জুডিয়া নাম পরিবর্তন করে এ অঞ্চলটির নাম দেন সিরিয়া ‘প্যালেস্তিানা’। পরবর্তীতে ১৩৪ খ্রিস্টাব্দের দিকে নামকরণ হয় ফিলিস্তিন বা প্যালেস্তাইন। রোমানদের পতনের পর বাইজান্টাইন, খিলাফত ও মামলুক সাম্রাজ্যেও এই নামে পরিচিত হয়ে আসছে ফিলিস্তিন। ১৬শ শতকে ওসমানীয় শাসন শুরু হলে বেসরকারি ভাবে এ অঞ্চলটি ফিলিস্তিন নামেই অটোমান তুর্কী তথা ওসমানীয়দের দ্বারা শাসিত হতে থাকে। ১৮৯৮ সাল থেকে ফিলিস্তিন নামটি বহুল প্রচরিত হতে থাকে জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকে।

৩। অল্পকথায় সব কথা:
দখলদার ইসরাইলিদের দ্বারা শত বছর ধরে নির্বিচারে নির্যাতিত নিপীড়িত হচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। লাশের পাহাড় আকাশ ছুয়েছে। ফিলিস্তিন ছিল মূলত অটোমান শাসনাধীন আরব মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি জনপদ। একটি নিজস্ব আবাস ভূমি গঠনের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদিরা ১৯ শতকের শেষ দিকে গড়ে তোলে জায়নবাদী আন্দোলন। দলে দলে ইহুদীরা আসতে থাকে ফিলিস্তিনে। ১৯১৭ সালে বৃটিশ সরকার ফিলিস্তিনে একটি ইহুদীদের জাতীয় বাসস্থান প্রতিষ্ঠার সমর্থন জানায়। এদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন হলে ফিলিস্তিনের শাসনভার তথা ম্যান্ডেট পায় বৃটিশরা। ১৯২০, ১৯২১, ১৯২৮, ১৯২৯ ও ১৯৩৬ সালে আরবদের সাথে ইহুদীদের সংঘর্ষ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে বৃটিশরা ফিলিস্তিনের ম্যান্ডেট ছেড়ে দিতে চায় এবং ফিলিস্তিনকে দ্বিখন্ডিত করে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেয়। আরবদের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের নীল নকশায় এ প্রস্তাবটি এগিয়ে যেতে থাকে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে বৃটিশ সরকার আনুষ্ঠানিক ভাবে ফিলিস্তিনের ম্যান্ডেট শাসন ছেড়ে দেয় এবং ঐ দিনই ইহুদিরা ইসরাইল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়। শুরু হয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধ। এ যুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে ইসরাইল জিতে যায়। পরবর্তীতে ১৯৫৬, ১৯৬৭, ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল আরও তিনটি বড় রকমের যুদ্ধ হয়। কিন্তু এসব যুদ্ধ ও পরবর্তী সংঘাত ফিলিস্তিনি জনগণের জীবনে বয়ে এনেছে এক অনিঃশেষ দুঃখগাথা। যা আজও পূর্বেকার এক একটি দিনের চেয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিদিন।

৪। ফিলিস্তিন সংকটের মূল কথা:
ফিলিস্তিন সংকটের মূল কথা হলো একই ভূখন্ডের ওপর আরবীয় মুসলমান ও ইহুদীদের পরস্পর বিরোধী দাবি। এ দাবির প্রেক্ষিতে এই দুই জাতীয়তবাদ তথা আরব জাতীয়তাবাদ ও ইহুদী জাতীয়তাবাদের মধ্যে সংঘাত।

৫। পরস্পর বিরোধী দাবির ভিত্তি:
ফিলিস্তিনের ওপর ইহুদিদের দাবির মূলভিত্তি ঐতিহাসিক স্মৃতি। ইহুদিরা মূলত হযরত দাউদ (আঃ) ও হযরত সুলায়মান (আঃ) এর শাসনকালে শান্তি-শৃংখলার সাথে জেরুজালেম শাসন করেছেন। তাদের ঐতিহাসিক স্মৃতির অন্যতম একটি দিক হলো Old Testament -এ বর্ণিত প্রভুর সাথে মনোনীত ইহুদি জাতির পবিত্র অঙ্গিকার। Old Testament -এ বর্ণিত বিভিন্ন কাহিনী ফিলিস্তিনে এক বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ ইহুদি রাষ্ট্র গঠনে ইহুদিদের প্রেরণা হয়ে আছে। আরবদের দাবির ভিত্তি বাস্তবতা ভিত্তিক ও ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত। মূলত ইহুদীদের সব ঐতিহাসিক স্মৃতির উত্তরাধিকার মুসলমানরাও। উভয় ধর্মের মহাপুরষরা একই। উপরন্তু কিছু ঐতিহাসিক স্মৃতি মুসলমানদের নিজস্ব।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ্ বলেন, সুবাহানাল্লাজী আসরা বি আবদিহি লাইলা হিল মসজিদুল হারামা মিনাল মসজিদুল আকসা, (সূরা ইসরা, পারা- ১৫) অর্থাৎ ঐ সত্তার কসম যিনি তার বান্দাকে ভ্রমন করিয়েছেন কাবা থেকে মসজিদুল আকসা। এটি মূলত মহানবী (সা.) এর মেরাজ গমনের ঘটনা। হযরত উমরের খিলাফত থেকে শুরু করে উসমানীয় সাম্রাজ্য পর্যন্ত (১০৯৯-১২৯১ এর ক্রুসেড আমল বাদে) সুদীর্ঘ কাল পর্যন্ত মুসলমানদের শাসনাধীনে থাকার ফলে একটি ইসলামী ভাবধারা সম্পন্ন মুসলিম সংস্কৃতির সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠে ফিলিস্তিনে। দীর্ঘ শতাব্দী ধরে একটি সহনশীল আরবীয় সমাজ বিদ্যমান থাকায় আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার আলোকে আরবীয় মুসলমানরা দেশটির ওপর তাহাদের অধিকার দাবি করে।

৬। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
প্রাচীন সভ্যতায় অন্যতম বাহক ফিলিস্তিন ভূখন্ড। খ্রিস্টপূর্ব ৯ম সহাস্রাব্দে ফিলিস্তিনে মানুষের খেত- খামার ও স্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু হয়। গড়ে ওঠে আরিহা নামক নগরী। পরবর্তীতে আরিহা নগরীর পতনের পর যুগে যুগে বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের মানুষের দ্বারা শাসিত ও পরিচালিত হয়েছে ফিলিস্তিন। এদের মধ্যে রয়েছে কেনানীয়, আরামীয়, প্রাচীন মিশরীয়, ইসরাইল বংশের ইহুদি, ব্যবিলনীয়, পারস্য, প্রাচীন গ্রীক, রোমান, বাইজেন্টাইনীয়, উমাইয়া, আব্বাসীয়, সেলজুক, ফাতিমি, ক্রুসেডারগন, আইয়ুবি, মামলুক, উসমানীয়, বৃটিশ ম্যান্ডেট, জর্ডান (পশ্চিম তীর), মিশর (গাজা অঞ্চল) এবং বর্তমানে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন। ফিলিস্তিনের অপরাপর নামগুলো হলো কেনান, জায়ন, ইসরায়েল ভূমি, দক্ষিণ সিরিয়া, জুন্দ ফিলিস্তিন এবং পবিত্র ভূমি। যুগে যুগে অসংখ্য নবী রাসুলগনের পদচারণা ঘটেছে এ পবিত্র ভূমিতে। এখানে রয়েছে মুসলমান, ইহুদি ও খ্রিস্টান শাসনের এক বিশাল ঐতিহাসিক পেক্ষাপট।

৬.১ ফিলিস্তিনে কেনান সম্প্রদায়:
আনুমানিক সাড়ে চার হাজার বছর আগে আরব উপদ্বীপ থেকে কেনান সম্প্রদায় এ অঞ্চলে এসে বসবাস করে যার ফলে প্রাচীন ইতিহাসে ফিলিস্তিনকে ‘আরদে কেনান’ বলা হয়।

৬.২ ইয়াবুসি সম্প্রদায়:
প্রাচীন ফিলিস্তিনে বসবাসকারী আর একটি সম্প্রদায় ইয়াবুসি। এরাও আরব উপদ্বীপ থেকে আগত।

৬.৩ ইব্রাহীম আঃ এর আগমন:
হযরত ইব্রাহীম আঃ ও তাঁর স্ত্রী সারা খ্রিষ্টপূর্ব উনিশ শতকে ইরাক (ব্যবিলন) থেকে ফিলিস্তিনের জেরুজালেমে আগমন করেন।একটি মত অনুযায়ী জেরুজালেমে পৃথিবীর বুকে দ্বিতীয় পবিত্র ঘর বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণ করেন হযরত ইব্রাহীম (আঃ)। পবিত্র কাবা নির্মাণের ৪০ বছর পর নির্মিত হয় বায়তুল মুকাদ্দাস তথা মাসজিদুল আল আকসা। হযরত ইব্রাহীম (আঃ), তার পুত্র ইসহাক (আঃ) ও তাঁর পরবর্তী বংশধরদের দ্বারা পরিচর্ষিত হয় এ পবিত্র ভূমি।

৬.৪ ফিলিস্তিনে বনি ইসরাইল:
হযরত ইসহাক (আঃ) এর পুত্র ইয়াকুব (আঃ) এর জন্ম ফিলিস্তিনে। আর এই ইয়াকুব (আঃ) এর আর এক নাম ইসরাইল। ফিলিস্তিনে তার জন্ম হলেও পরে তুরষ্কে হিজরত করেন এবং পুনরায় তিনি ফিলিস্তিনে ফিরে আসেন। এই ইয়াকুব (আঃ) তথা ইসরাইল (আঃ) এর বংশধরদেরকেই বলা হয় বনি ইসরাইল। তখন ফিলিস্তিনে হেকমোস নামক একটি গোষ্ঠির শাসনামল ছিল। পাশ্ববর্তী সম্রাট কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে হেকমোসদের পতন ঘটলে বনি ইসরাইলদের জীবনে নেমে আসে নির্মম নির্যাতন। বনি ইসরাইলরা ছিল উত্তম চরিত্রের অধিকারী একটি সম্প্রদায়। প্রায় ৩০০ বছর ধরে চলা জুলুম নির্যাতনে বনি ইসরাইল সম্প্রদায়ের চরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। তারা এক পর্যায় মূর্তি পূজায় লিপ্ত হয়।

৬.৫ ফিলিস্তিনে মুসা (আঃ):
অত্যাচারিত বনি ইসরাইল লোহিত সাগর অতিক্রম করে মিশরের সিনাই উপত্যকায় হযরত মুসা (আঃ) এর নিকট চলে আসে। কিন্তু ততদিনে তাদের চরিত্রে যে নেতিবাচক পরিবর্তন এসেছে তারই ধারাবাহিকতায় তারা হযরত মুসা (আঃ) কে নানাবিধ কষ্ট দিতে থাকে। একপর্যায়ে মহান আল্লাহর নির্দেশে খ্রিস্টপূর্ব ১২৫০ সালের দিকে মুসা (আঃ) বনি ইসরাইলিদের নিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাস অভিমুখে রওনা হন। কিন্তু অত্যাচারী শাসকদের ভয়ে বনি ইসরাইলরা জেরুজালেমে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানায় ফলে আল্লাহর শাস্তি আসে এবং তারা সিনাই উপত্যকায় দিক ভ্রান্তের মতো ঘুরতে থাকে। এরই এক পর্যায় মুসা (আঃ) এর মৃত্যু হয়।

৬.৬ ফিলিস্তিনে ইউশা (আঃ):
মুসা (আঃ) এর মৃত্যুর পর বনি ইসরাইলিদের নেতৃত্বে আসেন হযরত ইউশা (আঃ) তিনি বনি ইসরাইলিদের নিয়ে জেরুজালেম তথা ফিলিস্তিন জয় করেন এবং তাদেরকে নিয়ে সেখানে বসবাস শুরু করেন। কিন্তু এই বনি ইসরাইলিদের মধ্যে আর শৃংখলা ফিরে আসেনি। তারা জড়িয়ে পড়ে পৌওলিকতায়।

৬.৭ ফিলিস্তিনে দাউদ (আঃ):
খ্রিস্টপূর্ব একাদশ শতকের শেষ দিকে বনি ইসরাইল গোত্রের নেতৃত্বে আসেন হযরত দাউদ (আঃ)। দাউদ (আঃ) এর সাথে স্থানীয়দের ব্যপক যুদ্ধ বিগ্রহের পর তিনি জয়ী হয়ে গড়ে তোলেন ইহুদিবাদী রাষ্ট্র। তিনি ফিলিস্তিনে ৪০ বছর শাসন করেন।

৬.৮ ফিলিস্তিনে সুলায়মান (আঃ):
দাউদ (আঃ) এর মৃত্যুর পর হযরত সুলায়মান (আঃ) ফিলিস্তিনের নেতৃত্বে আসেন। তিনি জ্বীনদের দ্বারা বায়তুল মুকাদ্দাস এর সংস্কার করান। তিনি প্রায় ৮০ বছর ন্যায় নিষ্ঠার সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তার মৃত্যুর পর বনি ইসরাইলরা তথা এ ইহুদি সম্প্রদায় ১২টি গোত্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এ ১২টি গোত্রের মধ্যে ১০টি গোত্র মিলে উত্তর অংশে একটি সাম্রাজ্য এবং বাকি দুটি গোত্র মিলে দক্ষিণ অংশে আর একটি সাম্রাজ্য গড়ে তোলে।

৬.৯ সম্রাট শিশাংক ও অ্যাসিরিয়ানদের আক্রমন:
খ্রিস্টপূর্ব ৯২০ সালে মিশরের সম্রাট শিশাংক ফিলিস্তিনের উত্তরাংশের সাম্রাজ্য দখল করে নেয় এবং পরবর্তীতে অ্যাসিরিয়ানরা দক্ষিণাংশের সাম্রাজ্য দখল করেন নেয়। ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ইহুদি ইসরাইলি সম্প্রদায়ের সম্রাজ্য।

৬.১০ ফিলিস্তিনে বুখতে নসরের আক্রমন:
খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে ইরাকের সেনাপতি বুখতে নসর ফিলিস্তিনের ওপর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ধ্বংস করে বায়তুল মুকাদ্দিস তথা আল আকসা। বন্দি করা হয় ৪০ হাজার ইহুদি। চূড়ান্ত অবসান ঘটে ইহুদি সাম্রাজ্যের।

৬.১১ ব্যবিলন ও পারসিকদের শাসন:
ইহুদিদের পতনের পর ফিলিস্তিনে ব্যবিলনীয় শাসনের উৎপত্তি হয়। ৫৩৯ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত চলে ব্যবিলনীয়দের শাসন। তারপর শুরু হয় পারসিকদের শাসনামল।

৬.১২ ফিলিস্তিনে রোমান শাসন:
রোমান সেনাপতি আলেকজান্ডার খ্রিস্টপূর্ব ৩২২ সালে ফিলিস্তিনের পারসিকদের পরাজিত করেন। তখন ফিলিস্তিনের ইহুদিরা বেশি সুবিধা পাবার আশায় পারসিকদের বিরুদ্ধে আলেকজান্ডার কে সহযোগিতা করেছে। ফলে ফিলিস্তিন রোমের অধীনে চলে আসে যা পরবর্তী সাত শতাব্দীকাল পর্যন্ত বাইজেন্টাইনের অধীনে ছিল।

৬.১৩ ফিলিস্তিনে যাকারিয়া, ইয়াহহিয়া মরিয়ম ও মুসা:
রোমানীয়দের শাসনামলেই ঈসা আঃ এর জন্ম হয়। বনি ইসরাইলরা যাকারিয়া, ইয়াহহিয়া (আঃ) কে করাত দিয়ে চিরে হত্যা করে। ঈসা (আঃ) কে শূলে চড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। খিস্টানরা ও ইহুদীরা বিশ্বাস করে তাকে হত্যা করা সম্ভব হয়েছে। তার মা মরিয়ম (আঃ) এর ওপর তারা ভয়ংকর অপবাদ আরোপ করে। তাদের এই পাপের কারণে মহান আল্লাহ্ ইহুদীদের ২য় বারের মত জেরুজালেম থেকে সমূলে উৎখাত করেন। অত্যাচারী বাদশা তাইতুস ফিলিস্তিন আক্রমন করে সব ধ্বংস করে দেন এবং হাজার হাজার বনি ইসরাইলকে বন্দি করেন।
মুসা আঃ এর হত্যার দায়ে খ্রিস্টানরা ইহুদীদের ওপর কয়েকশ শতাব্দীকাল প্রতিশোধ পরায়ন ছিল। মুসলমানরা বিশ্বাস করেন মহান আল্লাহ অলৌকিক ভাবে তাকে উর্ধ্বাকাশে নিয়ে যান।

৬.১৪ রোমান শাসনামলে ইহুদীদের শেষ বিদ্রোহ:
হযরত ঈসা (আঃ) এর সময়ে ১৩৫ খ্রিস্টাব্দে ইহুদীরা রোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। রোমান সম্রাট হাদ্রিয়ান ইহুদীদের ওপর ব্যপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। ইহুদিরা দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করে। তখন থেকে ৫৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আলকুদস রোমানদের অধীনেই ছিল।

৬.১৫ মুসলিম শাসনাধীন ফিলিস্তিন:
খলিফা হযরত ওমরের শাসনামলে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে ইসলামের বিজয় কেতন। মুসলিম বাহিনীর ইযারমুক বিজয়ের ফলে আল কুদসে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে রোমান খ্রিস্টানরা। দীর্ঘ ৪ (চার) মাস অবরোধের পর মুসলিম সেনাপতি আবু ওবায়দা ইবনে জাররাহ (রাঃ) বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হন। জেরুজালেমের বিশপ হযরত ওমরের নিকট আল আকসার চাবি প্রদানের শর্তারোপ করেন। তখন উমর (রাঃ) ফিলিস্তিনে আগমন করে খ্রিস্টানদের সাথে দুটি চুক্তি করেন। যথা- ১। খ্রিস্টানদের বিভিন্ন গির্জাঘর ও উপাসনালয় নিরাপত্তা পাবে।
২। এই পবিত্র শহরে কোন ইহুদি বসবাস করতে পারবে না।সেই ঐতহাসিক চুক্তিপত্র ‘আহদিয়াযে উমরিয়‍্যাহ’ নামে পরিচিত। হযরত আবু উবায়দাহ্ ইবনে জাররাহ, মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) যথাক্রমে এই অঞ্চলের মুসলিম খিলাফতের প্রতিনিধি হিসেবে শাসনকার্য পরিচালান করেন।

৬.১৬ উমাইয়া ও আব্বাসীয় আমলে ফিলিস্তিন:
৬৬০-৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলা উমাইয়া শাসনামলে ফিলিস্তিনে শান্তি শৃংখলা বজায় ছিল।
৪৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভূমিকম্পে আল-আকসা ক্ষতিগ্রস্থ হলে উমাইয়াদের কর্তৃক দ্রুত তা মেরামত করা হয়। উমাইয়াদের পতনের পর ৭৫০-১২৫৮ এ দীর্ঘ সময়ে মুসলিম বিশ্বে ক্ষমতাসীন ছিল আব্বাসীয়রা। এ সময়ে আল আকসার ঐতিহ্য ও উন্নতি বৃদ্ধি পায়। খলিফা হারুন-অর-রশীদ ও তার ছেলে মাহাদী এ মসজিদ পরিদর্শন করেন।

৬.১৭ ফিলিস্তিনে শিয়া মতাবলম্বীদের শাসন:
আব্বাসীয় খিলাফতের দুর্বলতার সুযোগ ৯ম শতাব্দীর শেষ দিকে শিয়া শতাবলম্বী উবায়দিয়ারা ফিলিস্তিনি দখল করেন নেয়। এ শাসনামলে ফিলিস্তিন জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়ে।

৬.১৮ ফিলিস্তিনে ক্রসেডারগণ:
পোপ দ্বিতীয় আরবান ১০৯৫ সালে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্রসেড তথা ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা দেয়। ১০৯৯ সালে সেনাপতি গডফ্রে ডিবো ইউনের নেতৃত্বে ক্রসেডারগণ জেরুজালেম দখল করে নেয়।
নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে তারা প্রায় ৯০ হাজার মুসলিমকে হত্যা করে। নিষ্ঠুর চরিত্র নিয়ে প্রায় ৯১ বছর জেরুজালেম শাসন করে ক্রসেডাররা। ব্যপক হত্যাযজ্ঞ চালায় ইহুদীদের ওপর।

৬.১৯ ফিলিস্তিনে সালাহউদ্দিন আইয়ুবি:
ক্ষমা ও মহত্বের অতুলনীয় নজির প্রদর্শন করে একজনও বেসামরিক খ্রিস্টান বা ইহুদির রক্ত না ঝরিয়ে ১১৮৭ সালে জেরুজালেম জয় করেন সালাউদ্দিন আইয়ুবী। ক্রুসেড পূর্ব মুসলিম শাসনামলে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ লক্ষ। কিন্তু খ্রিস্টান ক্রসেডারগনের অত্যাচার, নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের কারণে ১১৮৭ সালে ইহুদি পরিবারের সংখ্যা দাড়ায় মাত্র ১০০০। সালাউদ্দিন আইয়ুবি এ ইহুদিদের নিরাপত্তা ও সকল সুযোগ সুবিধা প্রদান করেন।

৬.২০ অটোমান শাসনাধীনে ফিলিস্তিন:
১৫১৬ সালে খারজ-ই-দাবিকের যুদ্ধে মামলুকদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে অটোমানরা ফিলিস্তিনের শাসনভার গ্রহণ করে। অটোমান শাসনামলে প্যালেস্টাইনের সীমানা ছিল মূলত রাফাহ (গাজার দক্ষিণ পূর্ব) থেকে লিটানি পর্যন্ত। অটোমান আমলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইহুদি ও খ্রিস্টানরা উপসনা, ব্যক্তিগত মর্যাদা, কর এবং তাদের স্কুল ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যপকভাবে সাম্প্রদায়িক স্বায়ত্তশাসন উপভোগ করত। অটোমানরা প্যালেস্টাইনকে ‘পবিত্র ভূমি’ উল্লেখ করে একটি বিমূর্ত পরিভাষা হিসেবে ব্যবহার করত। আরবীয় সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠা এ অঞ্চলটি ১৯১৭ সাল পর্যন্ত অটোমান সম্রাজ্যের অধীনে ছিল।

৬.২১ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও ফিলিস্তিন:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্য ছিল অক্ষ শক্তি এবং বৃটিশরা ছিল মিত্র শক্তি। ফিলিস্তিনিদের সমর্থন লাভের জন্য বৃটিশ সরকার হঠকারী আশ্বাস দেয়। যুদ্ধে অটোমানদের বিরুদ্ধে তারা জয়লাভ করলে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা দিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়। ফিলিস্তিনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল আরব মুসলিমগণ। সেই সপ্তম শতাব্দী ধরে গড়ে উঠেছে একটি আরবীয় মুসলিম সংস্কৃতির সমাজ ব্যবস্থা সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখন্ডে। অবধারিত ভাবেই ফিলিস্তিন নামেই স্বাধীনতা প্রাপ্ত হওয়ার কথা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এ অঞ্চলটির। কিন্তু যুদ্ধে বৃটিশরা জয়লাভ করে এবং ফিলিস্তিনকে স্বাধীনতা নয় বরং সমূলে ধ্বংস করার পরিকল্পনা নেয়।

৭। বেলফোর ঘোষণা: (সংযুক্ত)
শত বছর আগের ৬৭টি শব্দের একটি গোপন চিরকুট বিশ্বে এমন এক সংকটের জন্ম দিয়েছিল যা আজও সমাধান করা সম্ভব হয়নি। ২ নভেম্বর ১৯১৭ তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর এক চিঠির মাধ্যমে ইহুদিদের কাছে বার্তা পাঠায় যে বৃটিশ সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য একটি জাতীয় আবাস ভূমি প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।

চিঠিটি- প্রিয় লর্ড রথসচাইল্ড,
মহামান্য সরকারের পক্ষ থেকে নিম্নলিখিত এই বিবৃতিটি আপনাকে পাঠাতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। জয়নবাদী ইহুদি জনগনের আশা আকাঙ্খার সমর্থন দেয়া এই বিবৃতিটি মন্ত্রিসভায় পেশ করা হয়েছে এবং মন্ত্রিসভায় তা অনুমোদিত হয়েছে।’মহামান্য ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগনের জন্য একটি জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে এবং এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হবে। তবে এটাও নিশ্চিত করা হচ্ছে যে, এমন কিছু করা উচিত হবে না যা ফিলিস্তিনে অবস্থানরত অ-ইহুদি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও নাগরিক অধিকার এবং রাজনৈতিক মর্যাদা ভোগ করছে, তার কোন হানি হয়।আপনি যদি জায়নবাদী ফেডারেশনের কাছে এই ঘোষণা পৌঁছে দেন তাহলে আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো। অর্থার জেমস বেলফোর

৯। জায়নবাদী আন্দোলন:
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে অস্টিয়ায় জায়নবাদী তথা ইহুদীবাদী আন্দোলন শুরু হয়। ১৮৮০ সালে নাকান বেরেনবুয়া নামে এক অস্ট্রিয়ান ইহুদী ইহুদীদের জেরুজালেমে ফিরে যাওয়ার জন্য একটি আন্দোলনের প্রস্তাব দেয়। ১৮৯৬ সালে একজন ইহুদী সাংবাদিক থ্রিওডর হার্জেল জয়নবাদী আন্দোলনের রূপরেখা প্রনয়ন করেন এবং International Zionist Organization নামে একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তোলেন। প্রথমে ইউরোপ জুড়ে এ আন্দোলন বিপুলভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে আমেরিকা ও রাশিয়ায় এর উত্থান ঘটে। ইহুদীবাদী নেতাদের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী অসংখ্য সংগঠন গড়ে উঠে। যেমন আন্তর্জাতিক জায়নিস্ট লীগ, বেরিহাহ মুভমেন্ট, হাগানাহ ইত্যাদি। এসব প্রতিষ্ঠান প্রত্যক্ষ ভাবে কাজ করে ইহুদী স্বার্থ রক্ষা ও ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়। বহিরাগত ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনিদের থেকে জমি কেনা বা লিজ গ্রহণে অর্থায়নের জন্য গড়ে উঠেছে Jewish National Fund এভাবে বিশ্বব্যাপী চলমান রয়েছে জয়নবাদী আন্দোলন।

১০। ফিলিস্তিনে বৃটিশ ম্যান্ডেট শাসন ও মুসলমানদের উচ্ছেদকরণ:
১ম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি বৃটিশরা জয়লাভ করে। ফিলিস্তিনি মুসলমানরা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অপেক্ষায়। জয়ী মিত্রশক্তির তত্ত্ববধানে গড়ে ওঠে লীগ অব নেশনস বা জাতিপুঞ্জ নামক এক আন্তর্জাতিক সংস্থা। জাতি পুঞ্জের মাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে বৃটিশরা ফিলিস্তিনের ওপর চালু করে বৃটিশ ম্যান্ডেট শাসন। এ ম্যান্ডেটরি শাসনকাল ছিল মূলত ফিলিস্তিনে মুসলিম হ্রাসকরণ ও ইহুদী অভিবাসনকে সুযোগ করে দেওয়ার মোক্ষম সময়। মাত্র ৩০ বছরের ম্যান্ডেট শাসনামলে ফিলিস্তিনে মুসলমানদের সংখ্যা অর্ধেক নামিয়ে আনা হয়। বৃটিশদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় ইহুদিরা ব্যপক ধ্বংসযজ্ঞ ও নির্যাতন চালিয়ে দখলকরে নেয় মুসলিম বাড়ি-ঘর। মূলত ম্যান্ডেটরি শাসনামল ছিল মুসলমানদের উচ্ছেদের আমল।
১৯২১ সালে বৃটিশ ম্যান্ডেটরি ফিলিস্তিনে ইহুদিরা হাগানাহ নামক আধা সামরিক বাহিনী গড়ে তোলে। ১৯৩০ এর দশকে পোলান্ড থেকে ইহুদিরা এসে জমি কিনে কৃষি খামার গড়ে তোলে। এরপর দলে দলে ইহুদিরা এসে আরবীয়দের প্রলুদ্ধ করে, বেশি দাম দিয়ে আবার কখনবা জবরদস্তি করে জমি ক্রয় করে বসবাস ও চাষাবাদ শুরু করে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বসবাস করা আরবীয় মুসলিমরা বুঝা শুরু করে যে তারা ভিটে মাটি হারাচ্ছে।বৃটিশ বাহিনীর সহায়তায় ইহুদিবাদী সংগঠন হাগানাহ্, ইরগুন ও স্টান গাং মুসলিমদের ওপর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ১৯৩৩ সালে হিটলারের নেতৃত্বে জার্মাণ ন্যাৎসি বাহিনী ইহুদি নিধন শুরু করলে ইউরোপ থেকে দলে দলে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে ভিড় জমায়। ধীরে ধীরে কোনঠাসা হয়ে পড়ে ফিলিস্তিনিরা।

১১। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা:
ফিলিস্তিন জুড়ে ইহুদিদের অত্যাচার, নির্যাতন, আর ধ্বংস যজ্ঞে বৃটিশ বাহিনীও একপর্যায়ে বিব্রত হয়। ইহুদিরা একপর্যায়ে বৃটিশদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। নানা মুখী আন্তর্জাতিক চাপে বৃটেন ফিলিস্তিন ইস্যুটি জাতিসংঘে ছেড়ে দেয়। ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘে ভোটগ্রহণ করা হয়। তবে বৃটেনসহ ৩৩টি ভোট ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে, ১৩টি বিপক্ষে এবং ১০ দেশ ভোট প্রদানে বিরত থাকে। এরপর ইহুদিরা ভূমির ৫৫/৫৭ শতাংশ আর আরবীয়রা ৪৫/৪৩ শতাংশ জায়গায় নতুন বসতি স্থাপন করে। ইহুদিরা উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে বসতি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
নির্মম নির্যাতন, নিপীড়ন চালাতে থাকে মুসলমানদের ওপর। মুসলমানদের সমূলে উচ্ছেদ করে ভূখন্ড দখলের জন্য হত্যা, লুটতরাজ করতে থাকে নিয়মিত। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে তারিখে বৃটিশরা ফিলিস্তিনের ওপর তাদের ম্যান্ডেট ছেড়ে দেয়। ঐ দিনই জায়নবাদীদের প্রধান দাভিদ বেন গুরিয়নকে প্রধানমন্ত্রী করে ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয় এবং পূর্বপরিকল্পিত ভাবে ওই রাতের ১২.১০ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। পর্যায়ক্রমে বৃটেন, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার অনেক দেশ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফিলিস্তিনি মুসলমানরা হয়ে পড়ে বাস্তুহারা। ক্ষোভে ফেটে পড়ে আরব বিশ্ব। শুরু হয় আরব ইসরাইল যুদ্ধ।

১২। গাজা উপত্যকা:
৪১ কি.মি. দীর্ঘ এবং ১০ কিমি প্রশস্ত ফিলিস্তিনের একটি শহর গাজা। এখানে প্রায় ২২/২৩ লাখের মত মুসলমানদের বাস। ১৯৪৮ সালে মিশর এটি দখল করে। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরাইল এটি দখল করে নেয়। ২০০৫ সালে সেখান থেকে সেনা ও বসতি প্রত্যাহার করে নেয় ইসরাইল।

১৩। পশ্চিম তীর:
ফিলিস্তিনের বড় অংশ এই পশ্চিম তীর শহর। মূলত জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরের অংশ হওয়ায় এর নাম হয়েছে পশ্চিম তীর। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল এ অংশটিও দখল করে নেয় এবং ১৯৯৩ সালের চুক্তি অনুযায়ী সেনা প্রত্যাহার করলেও বসতি স্থাপন বাড়িয়েই চলছে ইসরাইল।

১৪। ফিলিস্তিনিদের নাকাবা:
১৫ মে তারিখ টিকে ফিলিস্তিনিরা আল নাকাবা অর্থাৎ মহা বিপর্যয়ের দিন হিসেবে পালন করে। মূলত ১৯৪৮ সালে ১৪ মে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা হলে ১৫ মে শুরু হয় আরব ইসরাইল যুদ্ধ। আর সে উপলক্ষ্যে প্রতিবছর উদযাপিত হয় ফিলিস্তিনিদের নাকাবা বা মহাবিপর্যয়ের দিন। ফিলিস্তিনিদের এই দিবসটি উদযাপনকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

১৫। প্রথম আরব ইসরাইল যুদ্ধঃ
১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘ প্রস্তাব গৃহীত হলে আরবরা এটা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারেনি কারণ তাদের ভূখন্ড কেড়ে নিয়ে ইহুদিদের জন্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব পাস হয়। জাতিসংঘে এ প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পরপরই শুরু হয় আরব ইসরাইল সংঘাত। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণার পর আরব- ইসরাইল সংঘাত পুরোপুরি সামরিক যুদ্ধে রূপ নেয়। মিশর, জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন ও ইরাক থেকে আরব বাহিনী ইসরাইলের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আরব বাহিনী ইসরাইলিদের ঘিরে ফেলে। ইসরাইলি বাহিনী তখন সম্ভাব্য পরাজয়ের মুখে। এমতাবস্থায় জাতিসংঘ যুদ্ধ বিরতির জন্য চাপ দেয়। চার সপ্তাহের যুদ্ধ বিরতি হলে ইসরাইলিরা চেকোস্লাভাকিয়া থেকে ভারি ভারি অস্ত্র সংগ্রহ করে। যুদ্ধ বিরতি শেষ হলে ইসরাইলিরা পাল্টা আক্রমন করে আরবদের নিয়ন্ত্রিত দুটো এলাকা দখল করে নেয়। এমনকি জাতিসংঘ ঘোষিত ফিলিস্তিনি এলাকা একের পর এক দখল করতে থাকে ইসরাইলিরা। বাস্তুচ্যুত হয় প্রায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনি। ইরাকি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ইসরাইলি ইতিহাসবিদ আভি শ্লেইম মনে করেন যুদ্ধের প্রথমদিকে আরব সেনাবহিনী কার্যকরী ভূমিকা পালন করলেও ইসরাইল যখন পাল্টা আক্রমন শুরু করে তখন সেটির বিরুদ্ধে আরব সৈন্যদের তেমন কোন কার্যকরী ভূমিকা দেখা যায়নি। মূলত আরব দেশগুলো নিজেদের স্বার্থে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। আরব দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে কোন সমন্বয় ছিল না। ১৯৪৮-১৯৪৯ সাল পর্যন্ত প্রায় দুবছর ধরে চলা এ যুদ্ধে আরবরা পরাজিত হয়। আরব দেশগুলোর সাথে ইসরাইলের একাধিক চুক্তির মাধ্যমে শেষ হয় এ যুদ্ধ।

১৬। ২য় আরব ইসরাইল যুদ্ধঃ
২য় আরব ইসরাইল যুদ্ধ হয় মূলত ইসরাইল বনাম মিশরের মধ্যে। ১৯৫৬ সালের ২৬ জুলাই মিশরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসের সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করেন এবং ইসরাইলি জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেন। ইসরাইল এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে সিনাই উপদ্বীপ আক্রমন করে। বৃটিশ ও ফরাসি সামরিক সহয়তায় ইসরাইল সিনাই উপদ্বীপ ও গাজা উপত্যাকা দখল করে নেয়।

১৭। ৩য় আরব ইসরাইল যুদ্ধ তথা ছয় দিনের যুদ্ধ:
আরব ও ইসরাইলের মধ্যে ক্রমাগত তিক্ততা ও সীমান্তের ক্ষুদ্র সংঘাতের প্রেক্ষিতে ১৯৬৭ সালে শুরু হয় তৃতীয় আরব ইসরাইল যুদ্ধ। ৫ থেকে ১০ জুন, ১৯৬৭ সালের এ যুদ্ধকে ৬ দিনের যুদ্ধ নামেও অভিহিত করা হয়। এ যুদ্ধে মিশর, জর্ডান এবং সিরিয়া ইসরাইলের কাছে পরাজিত হয়। ইসরাইল গাজা উপত্যকা, মিশরের সিনাই উপদ্বীপ, সিরিয়ার গোলান মালভূমি, জর্ডানের কাছ থেকে পশ্চিমতীর এবং পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়।

১৮। চতুর্থ আরব ইসরাইল যুদ্ধ:
১৯৭৩ সালে মিশর ও সিরিয়া জোট দখলদার ইসরাইল বাহিনীর ওপর অতর্কিত হামালা করে। তারা সিনাই উপদ্বীপ ও গোলান মালভূমির মধ্যে ঢুকে পড়ে। ৬ থেকে ২৫ অক্টোবর ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত চলমান এ যুদ্ধকে অক্টোবর যুদ্ধ বা রমজান যুদ্ধ বা ইয়োম কিপ্লর (ইহুদীদের পবিত্র দিন) যুদ্ধও বলা হয়। এ যুদ্ধেও আরবরা পরাজিত হয়।

১৯। আরব ইসরাইল যুদ্ধে আরবদের পরাজয়ের কারণ:
ফিলিস্তিন ইসরাইল যুদ্ধে আরবরা মূলত ফিলিস্তিনির চেয়ে নিজ নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষার্থেই বেশি মনোযোগী ছিল। আর এ স্বার্থ রক্ষার জন্য সৃষ্টি হয়েছিল নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। তাছাড়া আরব দেশগুলোর মধ্যে সামরিক সমন্বয় ছিল না। যেমন প্রথম আরব ইসরাইল যুদ্ধের সময় আরবদের একটি প্রধান সামরিক কার্যালয় ছিল যার প্রধান ছিলেন একজন ইরাকি জেনারেল কিন্তু মিশর, সিরিয়া, লেবানন ও জর্ডানের সেনাবাহিনীর ওপর তার কোন নিয়ন্ত্রন ছিল না। উপরন্তু ইসরাইলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষতায় ছিল পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেন।

২০। ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক দলঃ (ফাতাহ, পিএলও এবং পিএনএ):
ফাতাহ, প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) ও প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল অথরিটি ( পিএনএ) অনেকটাই একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ১৯৫৭ সালে কুয়েতে সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক দল আল ফাতাহ। মূলত কার্যক্রম শুরু করে ১৯৫৯ এ। এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসির আরাফাত। ১৯৬৪ সালের ২৮ শে মে জেরুজালেমে গঠিত হয় ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা তথা (Palestine Liberation Organization PLO)। একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৯ সালে ইয়াসির আরাফাত এর চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন। PLO এর বর্তমান চেয়ারম্যান মাহমুদ আব্বাস। মধ্যপন্থী এ সংগঠনটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি রয়েছে। ১৯৯৩-৯৫ সালের আসলো চুক্তির ফল স্বরূপ প্রতিষ্ঠিত হয় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ বা ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষ (PA/PNA) এটি মূলত ফাতাহ ও পিএলও নিয়ন্ত্রিত। পশ্চিম তীরের শাসন ক্ষমতায় রয়েছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ।

২১। হামাস:
মিশরীয় মুসলিম ব্রাদার হুডের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় হামাস। হামাস ১৯৯০ সাল থেকে ইসরাইল ফিলিস্তিন সংঘাতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। কট্টরপন্থী এ সংগঠন পিএলও ইসরাইল পারষ্পরিক স্বীকৃতির অস্বীকার করে এবং আসলো চুক্তি মানে না। ২০০৬ সালের ফিলিস্তিনি আইনসভা নির্বাচনে ১৩২ টি আসনের মধ্যে ৭৪ টিতে জয়লাভ করে হামাস। হামাস ও পিএলও এর বৈরিতা গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। ২০০৭ সালে প্রত্যক্ষ গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বে পশ্চিম তীরের দখল নেয় প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) এবং গাজার দখল নিয়ে হামাস ও তার সামরিক শাখা ইজ্জউদ্দিন আল কাসসাম বিগ্রেড সামান্তরাল শক্তি হিসেবে চলতে থাকে। প্রাথমিক দিকে সাফল্য পেলেও সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে আসাদ বিরোধী অবস্থান, ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে ইরান বিরোধী অবস্থান এবং মিশরের ব্রাদারহুডের পতন হামাসকে বন্ধুহীন করে দেয়। মিশরের ফাতাহ আল সিসি মুসলিম ব্রাদার হুডকে নিষিদ্ধ
করেন এবং গাজা মিশর সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। ইসরাইল ও মিশরের অবরোধে হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজা মূলত উন্মুক্ত কারাগারে পরিনত হয়।

২২। ফিলিস্তিনি ইন্তেফাদা:
ইন্তিফাদা বলতে দখলদার ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন তথা বড় রকমের বিদ্রোহকে বোঝায়। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৩ সালের মধ্যে প্রথম ইন্তিফাদা এবং ২০০০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে ঘটে ২য় ইন্তিফাদা। একটি ইসরাইলি সামরিক লবির সাথে সংঘর্ষে ফিলিস্তিনি চার জন শরণার্থীর মৃত্যু এবং কয়েকজন আহত হয়। ইসরাইল এটিকে দুর্ঘটনা বললেও ফিলিস্তিনিরা মনে করে এটি ইচ্ছাকৃত। বহু বছরের অত্যাচারিত নিপীড়িত ফিলিস্তিনিরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। শুরু হয় প্রথম ইন্তিফাদা তথা ফিলিস্তিনি নবজাগরণ।
প্রথম ইন্তিফাদা ছিল মূলত ফিলিস্তিনিদের অসহযোগ ও প্রতিরোধ মূলক আন্দোলন। কিন্তু ইসরাইল একে দাঙ্গা আখ্যায়িত করে নৃশংসভাবে দমন করে। প্রথম বছরেই ৩১১ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে এবং হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে পঙ্গু করে দেয়। এ আন্দোলনে ১৪০০ জন ফিলিস্তিনি এবং ২৭১ জন ইসরাইলি নিহত হয়। ১৯৯৩ সালের আসলো চুক্তির মধ্য দিয়ে প্রথম ইন্তিফাদার অবসান ঘটে।
২০০০ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় ইন্তিফাদা। ইসরাইলের বিরোধী দল লিকুদ পার্টির নেতা অ্যারিয়ল শ্যারনের আল আকসা মসজিদের সফরকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সংহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে পুরো ফিলিস্তিন জুড়ে। ২০০৫ সাল পর্যন্ত চলা দ্বিতীয় ইন্তিফাদার মারা যায় ৩৩৯২ জন ফিলিস্তিনি আর ৯৯৬ জন ইসরাইলি।

২৩। সাম্প্রতিক সংঘাত:
দীর্ঘকাল যাবত ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলিদের দমন, পীড়ন, হত্যাযজ্ঞ সাম্প্রতিক কালে সকল মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। ফিলিস্তিনিদের বিপন্ন জনজীবন বিশ্বমানবতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। দশকের পর দশক ধরে গাজাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে ইসরাইল। হামসকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করতে গাজার ওপর সব রকমের অবরোধ আরোপ করে আছে ইসরাইল। এমন এক পরিস্থিতিতে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস যোদ্ধারা গাজা থেকে ইসরাইলে বড় রকম একটি আক্রমন চালায়। হামাস এর সাংকেতিক নাম দেয় ‘অপারেশন আল আকসা ফ্লাড’। এদিন হামাস যোদ্ধারা গাজার দক্ষিণ সীমান্ত প্রাচীরের আশপাশের এলাকায় ঢুকে পড়ে। এবং ইসরাইলিদের ওপর হত্যাকান্ড চালায়। এতে প্রায় ১১৩৯ জন ইজরাইলি নিহত হয় যার অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। এছাড়া হামাস প্রায় আড়াইশ জনকে বন্দী করে নিয়ে আসে। (আল জাজিরা ৮ অক্টোবর ২০২৩)। হামাস বিবৃতিতে বলেছে, ৭ অক্টোবরের হামলা ছিল প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ তবে কিছু ত্রুটিও ছিল। ইসরাইল একে গণহত্যা, শিশু হত্যা ও ব্যাপক মাত্রায় ধর্ষণের অভিযোগ তোলে। বিশ্বনেতারাও বেশির ভাগই ইসরাইলের এই বক্তব্যের সমর্থন করে। তবে এসব অভিযোগের বেশির ভাগেরই সত্যতা পাওয়া যায়নি। হামাস বিবৃতিতে জানায় বেসামরিক লোকদের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে কাসসাম বিগ্রেড ধর্মীয় ও নৈতিক ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বেসামরিক লোকদের ওপর হামলা হয়ে থাকলে তা হয়েছে দুর্ঘটনাক্রমে এবং দখলদার বাহিনীর সাথে সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে। হামলার পর ইসরাইল গাজায় নির্বিচারে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রায় আট মাস ধরে চলা এই যুদ্ধ ৩৬ হাজার ৪৭০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন যার মধ্যে ২৩ হাজার নারীও শিশু এবং বাকিদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক (স্বাস্থ্য দপ্তর, হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজা)। গাজায় ইসরাইলি ধ্বংসযজ্ঞের কিছুটা অনুমান করা যায় দেশি বিদেশি মিডিয়াগুলোর সংবাদের শিরোনাম দেখে। গাজায় প্রায় ১৩ হাজার শিশুসহ ৩০ হাজারের বেশি মানুষ হত্যা করেছে ইসরাইল (ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০২৪ ডেইলস্টার বাংলা)
গাজা উপহত্যায় ইসরাইল বিমান হামলা (২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বাসস)
More than 10,000 Palestinians have been killed by the Israeli Army in the besieged Gaza strip since October 7 by heavy aerial and artillery bombard ments more than 4000 clirdren and 2550 women.

(7 November, 2023, AL ZAZEERA)

২৪। আল শিফা হাসপাতেল অভিযান:
মানবতার এক ভয়ানক বিপর্যয় ইসরাইলি বাহিনীর আল শিফা হাসপাতালে আক্রমণ। গত আট মাসের যুদ্ধে বার বার ইসরাইলি বাহিনীর হামলার শিকার হয়েছে গাজার হাসপাতাল গুলো। এসব হাসপাতাল থেকে আবিষ্কৃত হচ্ছে গণকবর।

২৫। আন্তজার্তিক সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা:
সংকট সমাধানে বার বার ব্যর্থ হচ্ছে জাতিসংঘ। নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো প্রদানের ক্ষমতাপ্রাপ্ত দেশগুলো ইসরাইল ফিলিস্তিন সংঘাতে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়েছে। কার্যত কোন ভূমিকাই রাখছে না ওআইসি। এ সংকটের সমাধান আরব লীগের সামর্থ্যের বাইরে। জাসিংঘের ব্যর্থতার মূল কারণ হলো ইসরাইলের সকল কর্মকান্ডের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা সমর্থন।

২৬। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা কতদূর:
২০১২ সাল থেকে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকের মর্যদা পেয়ে আসছে ফিলিস্তিন। সম্প্রতি ফিলিস্তিনকে পূর্ণ সদস্যপদ দেয়ার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহবান জানিয়ে সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। ১০ মে ২০২৪ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভোটাভুটিতে ১৯৩ টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৪৩ টি ফিলিস্তিনের পক্ষে ভোট দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, পাপুয়া নিউগিনি, আর্জেটিনাসহ ৯টি দেশ বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। ২৮ মে ২০২৪ ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউরোপের তিনটি দেশ স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও নরওয়ে। রাষ্ট্র হিসেবে সকল ইতিহাস, ঐতিহ্য, উপাদান ও আন্তর্জাাতিক স্বীকৃতি থাকার পরও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রটির ভাগ্য এখন পরাশক্তিগুলো হাতে।

২৭। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ:
কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে শুরু হওয়া ইসরাইল বিরোধী বিক্ষোভ বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের ৪০ টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়েছে। বিক্ষোভকারী বিশ্বদ্যিালয় শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ বল প্রয়োগ করছে। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ম্যানহাটন ক্যাম্পাসে এবং হার্ভার্ড এর চত্ত্বরে শিক্ষার্থীরা অস্থায়ী তাবু গেড়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে। ফিলিস্তিনির পক্ষে এ বিক্ষোভ ফ্রান্স, ইতালি ও অস্ট্রেলিয়াতেও ছড়িয়ে পড়েছে।

২৮। সংকটের ভবিষৎ কোন দিকে:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ফিলিস্তিন স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার কথা। কিন্তু হয়ে গেল বৃটিশ ম্যান্ডেট এর অধীন। এরপর বৃটিশ ম্যান্ডেট শেষে ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে হয়ে গেল ইসরাইল রাষ্ট্র। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা কতদূর? ১৯৯৩ সালের আসলো চুক্তি অনুযায়ী দ্বি-রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধান আসে। ফিলিস্তিনের হামাস প্রথম দিকে এ প্রস্তাবের বিরোধীতা করলেও এখন নমনীয়, কিন্তু ইসরাইল এ চুক্তি বাস্তাবায়নে কখনোই আন্তরিক ছিলো না। ১৯৬৭ সালের ইসরাইল পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয় অন্য দিকে ফিলিস্তিনিদের দাবি পূর্ব জেরুজালেম হবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটরা দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান সমর্থন করলেও রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইসরাইলের মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে সরিয়ে পূর্ব জেরুজালেম স্থাপন ছিল দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের ওপর কুঠারাঘাতে। ফিলিস্তিনিদের সীমান্ত কী হবে? রাজধানী কোথায় হবে? উভয় পক্ষকে কী কী করতে হবে? এসব জটিল প্রশ্নে ফিলিস্তিনিদের নির্মম বাস্তবতার সম্ভবত কোন পরিবর্তন হবে না। বিশ্ব মানবতা জেগে উঠুক। সমাধান হোক এ সংকটের।

তথ্যসূত্রঃ
আরমাজানী, ইয়াহিয়া, মধ্যপ্রাচ্য অতীত ও বর্তমান, ঢাকা, প্রথম পুনমুদ্রণ ১৯৯৪
জোয়ার্দার, সফিউদ্দিন, আধুনিক মধ্যপ্রাচ্য, ঢাকা, ২০০১
বিবিসি বাংলা রিপোর্ট, ৯ অক্টোবর ২০২
(7 November, 2023, AL ZAZEERA)
এম.এ. কাউসার, আধুনিক যুগে পশ্চিম এশিয়া, ইতিবৃত্ত প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৯

 

লেখক পরিচিতিঃ 

মোঃ রিয়াজুল হক (৩৫ বিসিএস)
প্রভাষক,ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ 
সরকারি ব্রজমহন কলেজ,বরিশাল

মন্তব্য করুন

[wpdevart_facebook_comment curent_url="https://barishalpatrika.com/%E0%A6%AB%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%A8-%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%95%E0%A6%9F%E0%A6%83-%E0%A6%90%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%BF%E0%A6%95/" order_type="social" title_text="" title_text_color="#000000" title_text_font_size="22" title_text_font_famely="monospace" title_text_position="left" width="100%" bg_color="#d4d4d4" animation_effect="random" count_of_comments="3" ]
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ববিতে গুচ্ছ “সি” ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত

বরিশালে ১ হাজার শয্যার চীনা হাসপাতাল ও ৬ লেন মহাসড়কের দাবিতে মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান

হকারদের দখলে বরিশালের বিনোদনকেন্দ্রগুলো, নজর নেই বিসিসি ও প্রশাসনের

তারেক রহমানকে গালি দেওয়ায় বৈছাআ নেতার বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড়

বরিশাল মহানগর জামায়াতের অগ্রসর কর্মী শিক্ষা বৈঠক সম্পন্ন 

বরিশালে পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের ঈদ পুণর্মিলনী অনুষ্ঠিত

ঈদযাত্রায় সড়কে ৩১৫ দুর্ঘটনায় নিহত ৩২২ জন : যাত্রী কল্যাণ সমিতি

বিতর্কিত ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে মণিপুরে ব্যাপক বিক্ষোভ

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় একই পরিবারের ৬ জনসহ নিহত ২৪

ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক ওমরি মসজিদ যেভাবে নির্মিত হয়েছে

১০

দুনিয়া বদলাতে চাইলে ব্যবসাই সবচেয়ে শক্তিশালী কাঠামো: প্রধান উপদেষ্টা

১১

আগামীকাল থেকে শুরু হচ্ছে এসএসসি পরীক্ষা

১২

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর-লুটপাট, সারাদেশে গ্রেফতার ৭২

১৩

দেশে স্টারলিংকের পরীক্ষামূলক যাত্রা শুরু

১৪

নিরাপদ ও স্বস্তিদায়ক যাত্রা নিশ্চিতকরণে বরিশালে র‍্যাব-৮ এর সাপোর্ট সেন্টার স্থাপন

১৫

বোরহানউদ্দিনে গৃহবধূর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

১৬

বরগুনার বদরখালীতে মদনটাক হত্যার ঘটনায় শপথপাঠ

১৭

বরিশালে চুরির অভিযোগে দুই যুবককে মাথার চুল কেটে নির্যাতন

১৮

ভোলায় অস্ত্র-ইয়াবাসহ বিএন‌পির ৫ নেতাকর্মী আটক

১৯

বরিশালে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে ২৫ জন আহত

২০