কোটা সংস্কার আন্দোলনে অস্থিরতা কমানে সংকট মোকাবিলায় রোববার নিরাপত্তা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বৈঠক ডেকেছিলেন শেখ হাসিনা। বৈঠকে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার সময় ফুরানোর বিষয়টি মানতে চাচ্ছিলেন না। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে যে জনস্রোতে তিনি ভেসে যাবেন, তার এ বিদায় সম্পর্কে খুব কম লোকই অনুমান করতে পেরেছিলেন।
নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের কথা না শুনলেও শেষ মুহূর্তে পবিরারের ঘনিষ্ঠজনদের পরামর্শে দেশ ছাড়েন তিনি। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বিবিসিকে এ তথ্য জানান।
শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার কিছু সময়ের মধ্যে তার বাসভবনে প্রবেশ করেন আন্দোলনকারীরা। এর আগে রোববার সকালে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছিল। এতে তিন বাহিনীর প্রধান, ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা ও পুলিশ কর্মকর্তারা অংশ নিয়েছিলেন।
জুলাই মাসে শুরু হওয়া বিক্ষোভের কারণে শেখ হাসিনার ওপর কয়েক সপ্তাহ ধরে চাপ বাড়ছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এটি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা। এ সহিংসতায় প্রাণ হারান কয়েকশ মানুষ। এরমধ্যে শুধু রোববার এক দিনে অন্তত ৯০ জন নিহত হন। নিহতদের বেশিরভাগ বিক্ষোভকারী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে তারা প্রাণ হারান। এ ছাড়া এ সময়ে জনতার হাতেও পুলিশের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
কর্মকর্তাদের বরাতে বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, ‘দুটি বিকল্প’ খোলা রাখতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। দেশ ছাড়ার সময়েও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বল প্রয়োগ করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা এতে রাজি হননি। রোববার সাধারণ মানুষ ও আন্দোলনকারীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঠপর্যায়ের সেনা ও সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তারা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়া পর বিষয়টি বুঝতে পারেন।
একাধিক সূত্রের বরাতে বিবিসি জানিয়েছে, সেনারা বেসামরিক লোকজনের ওপর গুলি চালাবেন না বলে সামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দেন। তবে তারা পুলিশকে নিরাপত্তা সহায়তা দেওয়ার কথা জানান।
অন্যদিকে পুলিশের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, তাদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি তখন প্রকাশ না পেলেও পরে সামনে আসে। অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বিবিসিকে বলেন, আমরা শুনেছি পুলিশের কাছে পর্যাপ্ত গোলাবারুদ ছিল না। তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। শেখ হাসিনা তাদের এ বিষয়টি শোনেননি। এ ছাড়া তখন কেউই সামনে বসে তার সঙ্গে দ্বিমত করতে রাজি ছিলেন না।
পরিস্থিতি উপেক্ষা করে বৈঠকের পর শেখ হাসিনা তার বার্তা দেন। তিনি আন্দোলনকারীদের ‘সন্ত্রাসী’ বলে অভিহিত করেন। তিনি জনগণের প্রতি ‘অগ্নিসংযোগকারীদের’ প্রতিরোধের আহ্বান জানান।
আন্দোলনকারীদের এমন পরিস্থিতির মুখে নিরাপত্তা বাহিনীর আশঙ্কা ছিল, তাদের হাত ধরে শিগগিরই দেশে গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি আসতে পারে। রোববারের সহিংসতার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আরও ক্ষোভ বাড়তে থাকে। পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠলে ঢাকামুখী লংমার্চ একদিন এগিয়ে আনার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণায় কর্তৃপক্ষ বিস্মিত হয়ে যায়।
গোয়েন্দাদের তথ্যমতে, ছাত্রদের দাবি মানুষকে আকৃষ্ট করছে। পরের দিন হাজারো মানুষ রাজপথে নামার বিষয়টিও গোয়েন্দারা অভিহিত করেন। ফলে নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের থামানোর চেষ্টা করলে আরেকটি রক্তপাত ঘটার আশঙ্কা দেখা দেয়। এমন পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান আবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেন।
গত মঙ্গলবার বিবিসিকে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, ‘আমার মা মোটেও দেশ ছেড়ে যেতে চাননি। আমাদের তাকে রাজি করাতে হয়েছিল। গত শনিবার সন্ধ্যা থেকেই পদত্যাগ করার কথা ভাবতে শুরু করেছিলেন।
জয় বলেন, ‘আমরা পরিবারের সদস্যরা তার কাছে অনুনয় করেছিলাম। আমরা তাকে অনুরোধ করে বলেছিলাম, এই জনতা উচ্ছৃঙ্খল, তারা সহিংসতার জন্য বেরিয়েছে, তারা তোমাকে হত্যা করবে। তোমাকে নিরাপদে নিয়ে যাওয়া দরকার আমাদের। সেখানে জনতার পৌঁছাতে যতটা সময় লেগেছিল, তার হাতে ততটাই সময় ছিল। তারা কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই বেরিয়ে যান।’
সূত্র জানায়, দিল্লিতে ভারতের সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সোমবার সকালে শেখ হাসিনা নিরাপদ আশ্রয়ের অনুরোধ জানাতে যোগাযোগ করেন। ভারতের দিক থেকে তাকে দেশ ছাড়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
জানা যায়, ওয়াশিংটন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের এক দিন আগে জানিয়ে দেয়, শেখ হাসিনার সময় শেষ। তার সামনে আর কোনো বিকল্প নেই।
মন্তব্য করুন