পশ্চিমাদের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নানা সংকটে জর্জরিত মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বলয় তৈরি করেছে ইরান। রেকর্ড নিষেধাজ্ঞা আর ক্রমাগত হুমকিও দমাতে পারেনি তেহরানকে। নানা কৌশলে মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য ধরে রেখেছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বিশ্ব ব্যবস্থাকে অগ্রাহ্য করে এর প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে জোটগত সম্পর্কও পোক্ত করেছে তারা। আর দেশটিকে এ অবস্থানে আনতে চালকের আসনে থেকে ভূমিকা রাখছিলেন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। তবে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় তার আকস্মিক মৃত্যুতে নানা সংকটে পড়তে যাচ্ছে ইরান।
ভূরাজনীতির প্রভাবশালী এই পরিচালকের মৃত্যুতে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সমীকরণ অনেকটাই পাল্টে যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের নানামুখী নিষেধাজ্ঞার মুখে টালমাটাল ইরানের অর্থনীতিও হুমকিতে পড়তে পারে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তাদের প্রক্সি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কের সমন্বয়ও ব্যাহত হতে পারে।
এপির প্রতিবেদনে বলা হয়, কয়েক দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সক্রিয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছিল তেহরান। বিশেষ করে লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, বাহরাইন ও ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর অর্থ ও সমরাস্ত্রের অন্যতম জোগানদাতা ছিল ইরানের সামরিক বাহিনী। নতুন প্রেসিডেন্ট এতটা আগ্রাসী হয়ে উঠবেন কি না, সেটা এখন বড় প্রশ্ন এসব সশস্ত্র গোষ্ঠীর কাছে।
এসব গোষ্ঠী মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ও ইসরায়েলি স্বার্থের জন্য ক্রমাগত হুমকি তৈরি করে আসছিল। এর মধ্যেই গত মাসে রাইসির সরকার সরাসরি ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলও ইরানের ইস্পাহান শহরে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এ ঘটনার আগে কেউ কখনো কল্পনাই করতে পারেনি মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ ইসরায়েলে সরাসরি হামলার সাহস করতে পারে! সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করে দেখিয়েছিলেন রাইসি।
শুধু এই হামলা নয়, কয়েক দশক ধরে ইরানের পরমাণু কার্যক্রম নিয়ে বেশ অসন্তুষ্ট ইসরায়েল ও পশ্চিমা দেশগুলো। এমনকি এ তালিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি আরবও। আর পশ্চিমা এসব শক্তির কোনো তোয়াক্কা না করে পরমাণু কর্মসূচি আরও জোরদার করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন রাইসি। এমনকি বেশ কয়েকবার ইসরায়েলকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার হুমকিও দিয়েছিলেন তিনি। রাইসির মৃত্যুতে দেশটির পরমাণু কর্মসূচিতেও প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম ফরেন পলিসি বলছে, রাইসির মৃত্যুর ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যকে আঞ্চলিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে পারে ইরান সমর্থিত হিজবুল্লা, হামাস ও হুথিদের মতো গোষ্ঠীগুলো।
রাইসির মৃত্যু শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয় বরং প্রভাব ফেলবে মধ্য এশিয়া ও ইউরোপীয় ভূরাজনীতিতেও। বিশেষ করে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে রুশ বাহিনীকে যে বিপুল পরিমাণ ড্রোন ও সমরাস্ত্র সরবরাহ করেছিল তেহরান, এখন সেই পদক্ষেপ কতটা ধারাবাহিক থাকবে, সে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এ ছাড়া রাইসির নেতৃত্বে আর্মেনিয়া-আজারবাইজান সংঘাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ইরান।
রাইসির মৃত্যুর ঘটনায় ইরানের অভ্যন্তরেও অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা করছে কূটনৈতিক মহল। তারা বলছেন, প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এখনই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এসব কূটনীতিকের মধ্যে একজন আমেরিকা সরকারের সাবেক স্টেট ফর হাউস বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জোয়েল রুবিন। ইরানের প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর পর তিনি বলেছেন, রাইসি ও তার সহযোগীদের মৃত্যুর নেপথ্যে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব এখনই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আগামী দিনে এ ঘটনা ইরানের রাজনীতি তো বটেই, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে।
২০২১ সালে ইব্রাহিম রাইসি ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলায় প্রতিবেশীদের পাশাপাশি চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বিশেষভাবে মনোযোগ দিয়েছিলেন তিনি। ইরানের এই কূটকৌশলের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য। ক্রমবর্ধমান প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যে বৃহৎ শক্তির বাইরে আঞ্চলিক বলয় তৈরি করেছে ইরান।
বিশ্লেষক রুবিন বলেছেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি নিজেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন রাইসিকে। শুধু প্রেসিডেন্ট হিসেবেই নন, আক্ষরিক অর্থেই খামেনি নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তাকে, যাতে তার অবর্তমানে ইরানের সবকিছু রাইসির ইশারায় পরিচালিত হয়। ফলে রাইসির মৃত্যুতে ইরানের পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করতে পারে। যেহেতু সর্বোচ্চ নেতার বয়স এখন ৮৫। এরপর রাইসি সর্বোচ্চ নেতার আসনে বসবেন বলে ধারণা করা হচ্ছিল। তাই রাইসির মৃত্যুতে দেশটির পরবর্তী নেতা নির্বাচন নিয়ে জটিলতা তৈরি হবে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, পশ্চিমা দেশগুলোর তরফ থেকে আরোপিত নানা নিষেধাজ্ঞার ধকল ইরানের অর্থনীতির পক্ষে আর বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। এমনই এক প্রেক্ষাপটে সাবেক প্রেসিডেন্ট রুহানিকে বিদায় নিতে হয়েছিল সব দায় নিয়ে। খামেনি যথারীতি থেকে যান ধরাছোঁয়া ও যাবতীয় সমালোচনার বাইরে। এর মধ্যে নতুন আইনসভায় মধ্যপন্থিদের অনুপস্থিতিতে কট্টর ও অতি কট্টরপন্থিদের মধ্যে এক ধরনের দ্বন্দ্ব দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। এর মধ্যে রাইসির মৃত্যু নতুন রাজনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে।
পশ্চিম এশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ নীতি নিয়ে গবেষণা করে বই লিখেছেন ত্রিতা পার্সি। তার মতে, রাইসির মৃত্যুতে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রেসিডেন্টের পদে উন্নীত হবেন। তবে তার পরও ৫০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করাতে হবে, যা মোটেই সহজ কাজ হবে না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সরকারবিরোধী অবস্থান চরম আকার ধারণ করেছে দেশটিতে। সম্প্রতি যে সংসদীয় নির্বাচন হয়, তাতে ভোটই দিতে যাননি মানুষজন। আর দুর্ঘটনার নেপথ্যে যদি জনগণের সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ে, তাতেও অশান্তি ছড়াতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ত্রিতা পার্সি।
এখনো রাইসির মৃত্যুতে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নতুন কী মোড় নেবে, তা নিয়ে সুস্পষ্ট করে বলার মতো সময় না হলেও সামনে যে মধ্যপ্রাচ্য সংকট আরও ঘনীভূত হতে যাচ্ছে, তা সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে। অনেকেই ধারণা করছেন, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে চলমান সংঘাতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে তার মৃত্যু।
মন্তব্য করুন