চরকিতে মুক্তি পেয়েছে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর চলচ্চিত্র ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’। কেন এই ছবি ব্যতিক্রমী, তার সুলুক সন্ধান। ওটিটিতে সাধারণত বাংলা সিনেমা তেমন একটা দেখা হয় না। পত্র–পত্রিকার সুবাদে আলোচিত ও মেধাবী পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত ও অভিনীত ৮২ মিনিটের ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ নামের ব্যতিক্রমী সিনেমাটি দেখলাম। নামকরণ, বিষয়বস্তু, অভিনয়শৈলী, সিনেমাটোগ্রাফি, শব্দ চয়ন, সাবলীল সংলাপ, নেপথ্য সংগীত, দৃশ্যায়ন, পোশাক—সব মিলিয়ে এই সিনেমাকে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর অন্যান্য সিনেমা থেকে বেশ আলাদাই মনে হয়েছে। ক্যামেরার পেছনের মানুষ হিসেবে নির্মাতা এবং একই সঙ্গে অভিনেতা হিসেবে এই প্রথম ফারুকীকে দর্শক দেখতে পেলেন। পরিচালক ফারুকীর সিনেমা মানেই নতুনত্ব, তাঁর সিনেমা মানেই নতুন ধারণার উপস্থাপনা, যা সব সময়ই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। জনাব এম এস ফারুকীর মতো উঁচু মানের চলচ্চিত্রকারের সৃষ্টি নিয়ে চলচ্চিত্রের বাইরের সাধারণ দর্শক হিসেবে একপ্রকার ধৃষ্টতা দেখানোর মতো সিনেমাটি নিয়ে কিছু একটা লেখার চেষ্টা করছি।
প্রথমেই আসা যাক নামকরণ নিয়ে। ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ নামকরণ করায় অনেক দর্শক প্রথমেই মনে করেছিলেন যে এটি আত্মজীবনীমূলক কোনো সিনেমা। পরে সিনেমা দেখে মনে হলো, এটি আসলে আত্মজীবনী বা অটোবায়োগ্রাফি নয়, প্রকৃতপক্ষে এটি হলো একটি স্মৃতিকথা বা মেমোয়্যার। লেখকের জীবনের ধারাবাহিক সময়ের কাহিনি বিস্তৃত আকারে প্রকাশ করা হলো আত্মজীবনী আর লেখকের কোনো বিশেষ ঘটনা বা স্মৃতি বা অনুভূতির প্রকাশই হলো স্মৃতিকথা বা মেমোয়্যার। এ বিবেচনায় সিনেমাটির নাম ‘অটোবায়োগ্রাফি’ না হয়ে ‘মেমোয়্যার’ হলে মন্দ হতো না। যদিও সাহিত্য বা চলচ্চিত্রে সব সময় গৎবাঁধা নিয়ম মানা সম্ভব নয়।
একেবারে নবাগত হিসেবে সিনেমায় এসেই জনাব ফারুকী বেশ প্রশংসনীয় অভিনয় করেছেন। সিনেমায় তাঁর ইশারা ভাষাও ছিল বেশ চমৎকার। একবারও মনে হয়নি যে তিনি প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করছেন। ফারুকীকে সিনেমাটিতে একজন সত্যিকার ফ্যামিলি ম্যানই মনে হয়েছে। সাধারণভাবে সিনেমায় তথাকথিত নায়ককে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, এই সিনেমায় ফারুকীকে তার চেয়ে একটু আলাদাভাবেই তুলে ধরা হয়েছে।
তবে এটা একদম ব্যতিক্রমধর্মী একটি পারিবারিক সিনেমা, যেখানে বর্তমান সময়ের সঙ্গে সম্পর্কিত বন্ধ্যত্ব ও শব্দদূষণ নিয়ে পুরো গল্পটি সাজানো হয়েছে। শব্দদূষণ নিয়ে আমার মনে হয়, এটাই ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র, যা সমাজসচেতনতায় একটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে। আমাদের সমাজে বিভিন্নভাবে শব্দদূষণ কী ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক রোগের সৃষ্টি করছে, এই সিনেমা তার একটি উদাহরণ। আমাদের আগামী দিনের কর্ণধার শিশুরাও যে এই নীরব ঘাতকের আক্রমণের শিকার, এই সিনেমা আমাদের সামনে সেটা তুলে ধরেছে। ভবিষ্যৎ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে সংবেদনশীলতা জাগ্রত করার ক্ষেত্রেও এই চলচ্চিত্র অনুকরণীয় হবে। প্রেম, পরকীয়া, ত্রিভুজ প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা, খলনায়ক, মারামারি-কাটাকাটি, দামি স্থানে গানের শুট ইত্যাদি না থাকলেও যে সিনেমা দর্শকনন্দিত হতে পারে, ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
আমাদের পাঠ্যপুস্তকে যৌনশিক্ষা বা যৌনস্বাস্থ্যবিষয়ক মৌলিক ধারণা না থাকাটাই বন্ধ্যত্ব বা ইনফার্টিলিটির প্রধান কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—এ বিষয়ও ফারুকী অনুধাবন করেছেন। তবে যাঁদের সন্তান হচ্ছে না, এমন দম্পতিদের মধ্যে স্ত্রীরাই যে বেশি প্রশ্নের সম্মুখীন হন, বিব্রত হন—এ বিষয়ও উঠে এসেছে। এটিও নির্মাতা পরিকল্পিতভাবেই দেখিয়েছেন। তবে সন্তানধারণের জন্য ব্যাকুল দম্পতিদের যে দুর্বিষহ যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হয়, সেই হাহাকার আর আর্তনাদ সুনিপুণ ও সুচারুভাবে এই সিনেমায় তুলে ধরা হয়নি। হয়তো স্পর্শকাতর বিষয় বলেই ইচ্ছে করেই পরিচালক এদিকে যেতেই চাননি বা যাননি। তবে শব্দদূষণ যে কীভাবে মায়ের গর্ভে থাকা অনাগত শিশুর স্বাস্থ্যের জন্যও ভয়ংকর ও ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করতে পারে, এই সিনেমার মাধ্যমে আমরা তা প্রত্যক্ষ করেছি। আশা করি এই সিনেমার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সবাই শব্দদূষণ সম্পর্কে সচেতন হবেন।সাম্প্রতিক কালে চলচ্চিত্রশিল্পের পালে যে হাওয়া লেগেছে, তা অব্যাহত রাখতে হলে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। ব্যতিক্রম সিনেমা নির্মিত হলে আন্তর্জাতিক দর্শকেরা আরও বেশি আকৃষ্ট হবেন বলে আমার বিশ্বাস। শুভকামনা থাকল প্রত্যেক ভালো চলচ্চিত্র নির্মাতার জন্য।